এত বড় অঘটন ঘটবে জানলে আমি কখনোই ঋতুর সাথে হসপিটালে আসতাম না, টাকা দিয়ে ব্যাপারটা সেটেল করার চেষ্টা করতাম। চুপচাপ বসে আছি আমি আর ঋতু পাশাপাশি দুটি চেয়ারে, সামনের আরেকটা চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে আমার স্ত্রী লাবনী। লাবনীর সাথে আমার বিয়ে হয়েছে ছয় বছর। আমাদের প্রেমের বিয়ে কি না জানি না। সত্যি বলতে কি আমি লাবনীদের বাসায় গিয়েছিলাম ওর সাইন্স টিউটর হিসেবে। ওই একদিনে পড়িয়েছিলাম কারণ পরদিনই ওর বাসা থেকে জানানো হলো আমাকে আর যেতে হবে না। আমি অবাক হয়ে গেলাম, কি করেছি আমি?
হঠাৎ ঝড়ো বাতাসের মত লাবনী একদিন আমার মেসে এসে উপস্থিত। আমি কি করবো না করবো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
চোখে চোখ রেখে লাবনী বললো,
- 'শুনুন আপনাকে আমার ভালো লেগেছে প্রথম দেখাতেই, ছাত্রী হয়ে স্যার কে বিয়ে করার মানসিকতা আমার নেই তাই পড়াতে যেতে বারণ করেছি। বুঝতে পেরেছি আপনি আমার সঙ্গে প্রেম করবেন না কিন্তু আপনাকে তো আমার পছন্দ, আমাকেও ভালো করে দেখুন, আমি সুন্দরী নই? পছন্দ না হলে বলে দিন চলে যাব, আর কখনো আসবো না।'
মেয়েটা একনাগাড়ে কথা বলছে। আমি তার চোখের মায়ায় তখন রীতিমত ডুবে গেছি।
কোনমতে ঢোঁক গিলে বললাম,
- 'পছন্দ, খুব পছন্দ হয়েছে তোমাকে।'
- 'জানি, আমি আমার বাসায় ম্যানেজ করবো তবে বেকার ছেলে মানবে না। আমার এক মামা আছে খুব কাছের , আমি ওনাকে বলে দিচ্ছি আপনি তার কাছে কাল যাবেন আর চাকরি হয়ে গেলে আমার বাড়িতে মিষ্টি নিয়ে যাবেন।'
- 'মানে?'
- 'মানে প্রেম ছাড়াই বিয়ে।'
- 'তুমি চিন্তা না করেই কথা বলছো। তোমার বয়স অনেক কম।'
- '১৮ হয়ে গেছে, সমস্যা কোথায়?'
লাবনীর পরিবার মেয়ের আবদারে আপত্তি করেনি আর আমার পরিবার থেকে তো আপত্তির প্রশ্নই আসে না। আমি মধ্যবিত্ত ফ্যামিলির ছেলে, ওরা উচ্চবিত্ত, লাবনী সুন্দরী, পরিবারের একমাত্র মেয়ে, সর্বোপরি আমার চাকরিটা ওর সুবাদে। এর বাইরে আর কি চাওয়ার থাকতে পারে? কিন্তু চাওয়ার যে থাকতে পারে সেটা আমি হাড়ে হাড়ে বুঝলাম যখন বিয়ের চার বছর পরেও আমাদের কোন সন্তান ঘরে এলো না। লাবনীর বান্ধবীর বড় বোন প্রখ্যাত গাইনোকোলজিস্ট এর শরণাপন্ন হলাম।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা সব হলো, একবার দুবার তিনবার। লাভ হলো না, আমি দেশের বাইরে যেতে চাইলাম। লাবনী রাজি হলো না, ও ওর মা না হতে পারার কষ্টটা মানিয়ে নিতে চাইছে। তবে সমস্যা হলো, লাবনীর সৌন্দর্য আমার মন কাড়তে পারছিল না আর। কেন যেন ওর সাথে কথা বলতে ভালো লাগছিল না, মেয়েটা সব সময় প্রাণোচ্ছল সুন্দরী যেন ঝলমল করছে কিন্তু আমার ভালো লাগেনা।
সেই সময়ে আমার জীবনে ঋতুর আগমন। ঋতু সুন্দরী নয়, বলা চলে এভারেজ চেহারার একটা নিম্নবিত্ত ফ্যামিলির মেয়ে। ওর আয়েই ওদের পুরো সংসার চলে। তারপরেও ঋতু মেয়েটির উপরে আমি প্রচন্ড রকম ভাবে আকর্ষিত হলাম। এটা কি শুধুই লাবনী আমাকে সন্তান দিতে পারেনি এজন্য নাকি অন্য কোন কারণ আছে জানিনা?
হঠাৎ করে ঋতু আমাকে অত্যন্ত কাঙ্খিত সংবাদটি শোনালো, ও আমার সন্তানের মা হতে যাচ্ছে কিন্তু এই সমাজ সেটা মানবে না। আমি বুকে পাথর চাপা দিয়ে নিজের সন্তানকে নষ্ট করতে ঋতুর সাথে একটা প্রাইভেট হসপিটালে গেলাম কিন্তু যে ডাক্তারের কাছে আমরা এসেছি উনি যে লতায় পাতায় লাবনীর খালা হোন সেটা জানতাম না। উনি নাকি আমাদের বিয়েতেও উপস্থিত ছিলেন। আমাকে প্রথম দেখায় একটু কনফিউশন হলেও বিয়ের ছবি মিলিয়ে লাবনীকে ফোন করেছেন।
ঘন্টা খানেক পর লাবনীর আগমন। বর্তমানে আমি বসে আছি ওর সামনে, চোখে চোখ মেলাতে পারছিনা। প্রথমে লাবনী নিজেই মুখ খুললো,ওর কন্ঠ ভেজা,
- 'সোয়েব আমি যেটা তোমাকে দিতে পারিনি সেই আশা তোমার পূরণ হয়েছে, কেন শেষ করে দিতে চাচ্ছো? আমি তোমাদের দুজনের মাঝে কোনো রকম কাটা হবো না বাচ্চাটা নষ্ট করোনা, ওটা একটা প্রাণ, তোমরা বরং বিয়ে করে নাও।'
আমি অস্ফুট কন্ঠে বললাম,
- 'তুমি মেনে নেবে?'
- 'না, সতীনের সংসার আমি করবো না, আমার পুরো জীবন পড়ে আছে আমার বয়স মাত্র পঁচিশ, আমি সরে যাচ্ছি তোমাদের জীবন থেকে, ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে দিব দয়া করে সাইন করে দিও।'
- 'সরি লাবনী।'
লাবনী একবারও পেছনে না তাকিয়ে চলে গেল, তবে আমি স্পষ্ট বুঝেছি ও কাঁদছিল।
********
আজ আমার মেয়ে রাইসার আঠারো তম জন্মদিন যদিও ঋতুর ইচ্ছে ছিল খুব ধুমধাম করে জন্মদিনটা পালন করবে কিন্তু আমার আর্থিক সামর্থ্য অতটা নেই। লাবনী আমাকে অনেক দয়া করে ছিল। ওর মামার দেয়া চাকরিটা আমি এখনো করছি তবে ঋতুকে চাকরি ছাড়তে হয়েছে।
গর্ভাবস্থার পুরো সময় তারপর বাচ্চার দেখভাল সবমিলিয়ে ও আর জবে ফেরত যেতে পারেনি। আয় খুব একটা না বাড়লেও ব্যয় বেড়ে গেছে প্রচুর। আমাদের পরিবার ছাড়াও ঋতুর পরিবারকেও অনেক সাপোর্ট দিতে হয় আর আমার গ্রামের বাড়িতে তো প্রতি মাসে টাকা পাঠাতে হয়। সবকিছু মিলিয়ে বেশ ঝামেলার মধ্যে থাকি। আজ যদি লাবনী আমার সাথে থাকতো তাহলে এই অর্থনৈতিক ঝামেলা পোহাতে হতো না কিন্তু অন্যদিকে যখন রাইসার মুখটা মনে পড়ে তখন দুনিয়া একদিকে আর আমার মেয়ে অন্যদিকে।
কলিজার টুকরা মেয়েটা কে তার ১৮ তম জন্মদিনে বিশেষ কিছু দিতে না পারলেও ভেবে রেখেছি সারাদিনটা ওর সাথে কাটাবো। অফিস থেকে ছুটি নিব, সময় হচ্ছে কাউকে দেয়া সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার, কোথায় যেন শুনেছিলাম আমি তাই করবো।
অফিসে পৌঁছেই দেখি আমার ডেস্কের উপরে একটা ফাইল। খুলে কিছুই বুঝলাম না। এসব আবার কি?
- 'স্যার একজন সকালে এসে আপনার ডেস্কে রেখে গেল, বস বললেন আমরা যেন হাত না দেই কি আছে এতে?'
জুনায়েদ নামে এক জুনিয়র অফিসার আমাকে প্রশ্ন করলো।
- 'আসলে কিছু বুঝতে পারছিনা।'
- 'স্যার আমি একটু দেখব যদি আপনি বলেন।'
- 'হ্যাঁ, দেখতো।'
- 'স্যার এগুলো তো ইনভেস্টিগেশন রিপোর্ট মানে মেডিকেল রিপোর্ট। স্যার জানেন তো আমি এখানে চাকরি করার আগে দু'বছর মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করেছি সেই সুবাদে অনেক কিছুই আমি জানি।'
ছেলেটা বেশ কিছুক্ষণ কাগজপত্র দেখছিল। এমন সময় আমার হোয়াটসঅ্যাপে একটা মেসেজ আসলো। ওপেন করতেই দেখি লাবনীর ছবি। কি আশ্চর্য! এতদিন পর ও আমার নাম্বার কোথায় পেল? নায়াগ্রা ফলসের সামনে দাঁড়ানো লাবনী পাশে একজন সুপুরুষ আর ১৪-১৫ বছরের দুটি জমজ ছেলে। লাবনী তাহলে দুই বাচ্চার বাবাকে বিয়ে করেছে? অবশ্য আর কিই বা করবে যত সুন্দরী আর উচ্চবিত্তই হোক না কেন ডিভোর্সি মেয়েদের দাম আছে নাকি?
- 'স্যার এখানে ইনফার্টিলিটি রিপোর্ট দেখাচ্ছে, মেয়েটির রিপোর্ট নরমাল, ছেলেটির সমস্যা।'
- 'মানে!'
আমি আকাশ থেকে পড়লাম।
- 'মানে স্যার ছেলেটির বাবা হওয়ার ক্ষমতা নেই।'
জুনায়েদ কাগজগুলো গোছাতে গোছাতে বললো,
- 'স্যার যার ফাইল তাকে বলুন ভেঙ্গে না পড়ে ডাক্তারের সাথে পরামর্শ করতে এখন তো আর আগের যুগ নেই দশ পনেরো বছর আগেও যা এভেলেবেল ছিল না এখন সেটা সম্ভব।'
আমার পৃথিবী ঘুরতে লাগলো। মেয়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠলো। লাবনী জানতো সবকিছু, আমায় কিছু বলেনি, ছোট করতে চায়নি। আমার পরিবার ওকে দুই এক কথা শোনায় নি এমন কিন্তু নয়, ও চুপ করে গেছে। ওই বাচ্চা দুটো কে? ঐ ছবিটা আবার দেখলাম হ্যাঁ ওর সাথে চেহারার অনেক মিল।
আমার ফোনটা বেজে চলেছে। আমার একমাত্র মেয়ে রাইসা ফোন করছে। স্ক্রিনে ওর ছবি ভাসছে, আমি চোখ বন্ধ করে ফেললাম, রাইসা আমার মেয়ে নয়, রাইসা আমার রক্ত না, ঋতু কি করলো আমার সাথে? রাইসা তাহলে কার মেয়ে!
আমার কেমন বমি বমি লাগছে, বুকের ঠিক মাঝখানে প্রচন্ডরকম ব্যথা হচ্ছে ,মাথা ঘুরাতে লাগলো। রাইসা সত্যি সত্যিই আমার রক্ত না, ১৮ বছর যাকে এই বুকের মধ্যখানে চেপে রেখে মানুষ করেছি, সে আমার মেয়ে না! এটা কিসের শাস্তি? কাউকে প্রতারণা করার শাস্তি এতটা কঠোর হয়, এতটা!
(সমাপ্ত)...
#ছোটগল্প
#প্রতারণা
#সুবর্না_শারমিন_নিশী
Post a Comment