মুখে না বললেও ভালোবাসি।

 



কিরে তোর বুড়ো বরের সাথে কেমন চলছে সংসার?সবকিছু ঠিকঠাক তো নাকি,,,,,,, ভ্রু নাচিয়ে রূপন্তিকে উদ্দেশ্য করে বলে শিফা। আর শিফার এমন কথায় হেসে উঠলো সবাই।  আড্ডার মাঝখানে শিফার এমন কথায় চমকে উঠে রূপন্তি।  অসমাপ্ত কথা দ্বারা কি বলতে চেয়েছে  সে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে।  কথার মানে টা বোঝে চোখে মুখে কাঠিন্য ভাব দেখা দিলো তার। হাসতে হাসতে রত্মা বলে উঠে, আরে ওর বর তো ঘুনেধরা কাঠের মতো। বাইরে থেকে সুন্দর মনে হলেও আসলে ভেতরে ঘুনে খেয়ে ঝাঝড়া করে ফেলছে। ঠিক বললাম তো রে রূপন্তি? আবারও হাসির ঢল পড়ে। চোখ বন্ধ করে সবার কথা হজম করছে রূপন্তি।  পাশ থেকে রূপন্তির খুব কাছের বান্ধবী রিমি সকলের উদ্দেশ্যে বলে, তোদের খেয়েদেয়ে আর কাজ নেই?  সবাই কে পিন্চ মেরে কথা বলা তোদের স্বভাব।  তোরা বাহ্যিক দিক মানুষ বিচার করিস। শিফা ওকে থামিয়ে দিয়ে বলে তোর এতো জ্বলছে কেন রে?   আর রূপন্তি তোকে তোর বুড়ো বর সুখ দেয় তো? ইউ নো না হোয়াট আই মিন।   রূপন্তি ভেবেছিলো সে উত্তর দিবে না কিন্তু শেষের কথায় আর চুপ থাকতে পারলো না।আজকে কিছু না বলে যদি এদের মুখ বন্ধ না করে তাহলে এরা পেয়ে বসবে।  তারপর বলে,


সুখ দেয় কি দেয় না সেটা দেখার জন্য আমার বাসায় চলে আসিস একদম নিজের চোখে দেখে যাস। একজন ৩৬ বয়সী পুরুষ যদি বুড়ো হয় তাহলে আমার বর বুড়োই। তাতে তোদের এতো টেনশন কেন?  আমি এই মানুষটাকে নিয়েই সুখী। কারণ সে আমার উপর পুরুষত্ব জাহির করে না।তার প্রায়োরিটি লিস্টের সবার উপরে আমি। আমার অসুস্থতায় যে বিচলিত হয়ে পড়ে  তার সাথে সংসার জীবনে আমি অসুখী হবো?  বাবা যখন ওনার সাথে  বিয়ে ঠিক করেন আমি খুব রেগে গিয়েছিলাম। বলেছিলাম এ বিয়ে করতে পারবো না।  বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, কোনো বাবা তার সন্তানের খারাপ চায় না। বিয়ের পর তুই বুঝবি একটা খাঁটি মানুষের হাতে তোকে তুলে দিয়েছি। বুঝলি আসলেই সে খাঁটি নাহলে প্রথম রাতে যেখানে সব পুরুষ নিজের কর্তৃত্ব ফলায় সেখানে সে আমার  হাত ধরে বলেছিলো, আমার আর তোমার বয়সের পার্থক্য ১৪ বছর। জানি এটা তোমার মানতে কষ্ট হবে। আমি তোমার অনুমতি ব্যতীত স্পর্শ করবো না তবে একটা কথা মাথায় রেখো আমি থেকে শুরু করে এই পুরো সংসারটাই তোমার।  এগুলো অবহেলায় অযত্নে ফেলে রাখলেও তোমার আবার যত্ন করে আগলে রাখলেও তোমার।  আমার বাবা মা কেউ নাই। বোনটাকে ও  বিয়ে দিয়ে দিয়েছি। আবার তুমি মানুষটাও আমার। নিজের কোন অযত্ন করোনা। বল এই মানুষটার সাথে অসুখী থাকবো আমি? 


বিশেষ দিন গুলোতে আমার ব্যথিত মুখ দেখে যেই পুরুষ বিচলিত হয়ে পড়ে। সারারাত বুকের সাথে মিশিয়ে রাখে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বিভিন্ন কথা বলে আমার মনোবল বাড়ায় আমি তার সাথে অসুখী থাকবো?  যে মানুষটা প্রতিদিন অফিস থেকে আসার সময় আমাকে জন্য এক আকাশ পরিমান ভালোবাসা নিয়ে আসে তার সাথে অসুখী থাকবো? কাঁচের চুড়ি এনে বলবে এটা তার বাচ্চা বউয়ের জন্য। জানিস আমি যখন প্রথমবার কনসিভ করি তার সপ্তাহ খানিক আগে সে ছোট ছোট পায়ের একজোড়া জুতো এনেছিলো। ওনার নাকি এগুলো দেখে ভালো লেগেছে।  তারপরই জানতে পারি আমার মাঝে আরও একটি প্রাণ আছে।  সেদিন সে কি যে খুশি হয়েছিল। আবার যখন ভার্সিটি আসা যাওয়ার ধকল নিতে না পেরে মিসক্যারেজ হয় তখন সে বিধ্বস্ত অবস্থায় ছিলো। যেখানে আমার মাও আমাকে কথা শুনিয়েছে সেখানে সে আমাকে সান্ত্বনা দিয়েছিলো। বলেছে আল্লাহ যা করে ভালোর জন্য করে। আল্লাহ আমাদের পরীক্ষা নিচ্ছে তুমি ভেঙে পড়ো না। আজ চারটি বছর হয়ে গেলো এখানো কোনো সুখবর শোনাতে পারলাম না।  তারপরও তার কোনো অভিযোগ নাই।  তার একটাই কথা আল্লাহ চাইলে অবশ্যই হবে।  শিফা তুই তো স্মার্ট কম বয়সী ছেলে দেখে বিয়ে করেছিস  তার কাছে তোর দাম কতটুকু?  দুজনেই মোবাইল নিয়ে পড়ে থাকিস ভালো করে টাইম দিস না। আর আমার ওনি বলবে আমি কাছে আছি নো মোবাইল। এই সময়টা একজন আরেকজনকে দিবো। এখন তার অফিস টাইম। এই সময় আমি কখনো কল দেই না।  এখন কল করলে দেখবি কেমন আতংক নিয়ে কথা বলে।  


মোবাইল বের করে কল দেয় রাফাতকে।  দুই বার রিং হওয়ার পরে রিসিভ করে।  


- কি ব্যপার রূপু তুমি তো এই সময় ফোন করো না।  কোনো সমস্যা?  কোনো সমস্যায় পড়েছো নাকি। শরীর খারাপ লাগছে?


- কোনো সমস্যা না।  এমনি কল দিলাম। আজকে আপনার সাথে পুরো ঢাকা শহর ঘুরতে ইচ্ছে করছে।  তাছাড়া আপনার জন্য দু দুটো সারপ্রাইজ আছে।  এখন বলেন আসবেন কি না? 


- বউ বলেছে আসতে আর আসবো না?  তার উপর আবার সারপ্রাইজ আছে নাকি তখন আসতেই হয়। দাঁড়াও বসকে বলে বের হচ্ছি।


কল কেটে শিফা আর রত্নাকে উদ্দেশ্য করে বলে,  আমার যখন ১৮ বছর বয়স তখন ওনার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হই। আর এখন ২৩ বছর চলে। ৫ বছরের সংসার জীবনে তাকে আজও বলিনি যে ভালোবাসি।  আজ তোদের সামনে বলছি এই বুড়োটা কে নিজের থেকেও বেশি ভালোবাসি। আসি হে এখনই ওনি চলে আসবে। বলেই গেইটের দিকে অগ্রসর হয় সে। কিছু পথ গিয়ে আবার ফিরে আসে।  আবার ওদের দিকে তাকিয়ে বলে, আমার এমন স্মার্ট বর দরকার নেই যে অন্য কোনো নারীর অর্ধ/ন/গ্ন  ছবি দেখিয়ে বলবে এর মতো হতে পারো না?  যা শিফার বর বলে। শিফা নিজেই বলেছে।  অথচ আমার বর বলে আমি তার চোখে সবসময় সবার সেরা। তোদের চোখে যেমন সে বুড়ো আমার চোখে সে সুদর্শন। কাউকে কখনো পিন্চ মেরে কথা বলবি না।রূপন্তির কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলে ওরা। 


রিক্সায় করে ঘুরছে দু'জন।  হঠাৎ করে রূপন্তি বলে হাসপাতালে চলেন রাফাত সাহেব। রিপোর্ট আনতে যাবো।  রাফাত বিচলিত হয়ে বলে,


- হাসপাতালে কেন? তোমাকে কয়েকদিন ধরে দেখছি কেমন ক্লান্ত ক্লান্ত লাগে।নিশ্চয়ই ঠিকঠাক খাবার খাও না। তোমাকে নিয়ে আর পারি না।  না জানি আবার কি বাধিয়েছো। আমাকে টেনশন না দিলে হয় না।  মুচকি হেসে রূপন্তি বলে, 


-কুল ডাউন স্যার।  আমার কিছু হয়নি। রিপোর্ট দেখলে বুঝবেন।  বলেই রাফাতের হাত জড়িয়ে ধরলো। 


ডাক্তারের সামনে বসে আছে দু'জন। রাফাতের শরীর ঘেমে যাচ্ছে টেনশনে।  তখনই ডাক্তার মুচকি হেসে বলে, 


- কনগ্রেচুলেশন মিসেস আহমেদ রিপোর্ট পজিটিভ।  রূপন্তি চোখে মুখে আনন্দ নিয়ে বলে,


- আমি আগেই ধারণা করেছি। তারপরও সিউর হওয়ার জন্য টেস্ট করলাম। 


তাদের দুজনের কথা সব মাথার ওপর যাচ্ছে রাফাতের। রূপন্তিকে বলে,


- আমাকেও শোনাও কি পজিটিভ এসেছে।  টেনশন হচ্ছে আমার। 


রূপন্তি কিছু না বলে রিপোর্ট তার দিকে এগিয়ে দেয়। রিপোর্টের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বসা থেকে উঠে চলে যায় সে।  ডাক্তার রূপন্তিকে বলে,


- কি ব্যপার মিসেস আহমেদ মিস্টার আহমেদ কি খুশি না আপনি যে প্রেগন্যান্ট এটা জেনে? 


- মানুষ যখন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে বহুল প্রত্যাশিত কিছু পায় তখন অনুভূতি প্রকাশ করতে পারে না। ওনারও সেই অবস্থা হয়েছে।  আসি তাহলে। 


রূপন্তি হাসপাতালের করিডোরে গিয়ে দেখে রাফাত দেয়ালের দিকে তাকিয়ে কান্না করছে।  সে রাফাতকে চিমটি কেটে বলে, 


-বুড়ো বয়সে এমন টিনএজারদের মতো কান্না করছেন কেন? 


রাফাত রূপন্তিকে ঝাপটে ধরে বলে এই সারপ্রাইজের কথা বলেছিলে?  রূপন্তি বলে,


- আরে আরে করে কি মানুষ দেখছে তো। 


- দেখলে দেখুক। আমি অন্যের বউকে জড়িয়ে ধরেছি নাকি যে ভয় পাবো। আমি আমার বউকে ধরেছি।  এখন বলো এটাই সারপ্রাইজ ছিলো?


- হুম এটাই সারপ্রাইজ ছিলো। দেখি কান্না থামান। বাসায় চলেন বাসায় দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে কান্না করবো। তার আগে  সবাই কে খবরটা দিতে হবে। বাবা মা জানলে কি খুশি হবে জানেন আর রাহা সে পাগল হয়ে যাবে। তার ভাই বাবা হবে। 


- আর একটা সারপ্রাইজ কি?


রূপন্তি এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে রাফাতের গালে চুমু দিয়ে বলে ভালোবাসি। 


এইদিকে রাফাত স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রূপন্তি আঙুল এর ভাঁজে তার আঙুল রেখে বলে,  এই মানুষটাকে আমি ভালোবাসি। কখনো বলা হয় নাই।  মুখে না বললেও ভালোবাসি। 


#সমাপ্ত

#অণুগল্প

#মুখে_না_বললেও_ভালোবাসি 

লেখিকাঃরূপন্তি_রাহমান (ছদ্মনাম)


ভুলত্রুটি মার্জনীয়। গল্প আর বাস্তব ভিন্ন। দয়া করে মিলাতে যাবেন না।



Post a Comment

Previous Post Next Post